রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:০৯ অপরাহ্ন

ক্লাসে ফিরতে চায় শিক্ষার্থীরা, বাধা শিক্ষা ব্যবস্থাপনা

ক্লাসে ফিরতে চায় শিক্ষার্থীরা, বাধা শিক্ষা ব্যবস্থাপনা

স্বদেশ ডেস্ক:

প্রায় দুই বছর শ্রেণিকক্ষের স্বাভাবিক পাঠ গ্রহণ থেকে বঞ্চিত শিক্ষার্থীরা। নতুন বছরেও স্কুল ছুটিতে আটকা পড়েছে তাদের শিক্ষাজীবন। তারা আর ঘরে বসে থাকতে চায় না। ক্লাসে ফিরতে চায় তারা। কিন্তু তাদের ক্লাসে ফেরার পথে শিক্ষার ব্যবস্থাপনা বড় বাধা। বাস্তবতা তা-ই বলছে। এমন পরিস্থিতিতে যেসব শিক্ষার্থী টিকা নিয়েছে তাদের ক্লাসে ফেরার ব্যবস্থা করার পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষাবিদরা। তাদের পরামর্শ জীবন-জীবিকা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন চলমান রাখাও গুরুত্বপূর্ণ।

এদিকে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দ্বিতীয় দফায় বাড়ানো হচ্ছে আরও ১৫ দিনের ছুটি। এই খবরে অনেক শিক্ষার্থী প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে যে, স্বাস্থ্যবিধি মেনেই ক্লাসে ফিরতে চায় তারা।

গতকাল বুধবার শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে না আসায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চলমান ছুটি আরও দুই সপ্তাহ বাড়ছে। এক ভিডিওবার্তায় তিনি এ কথা জানান। এর আগে নতুন করে করোনার সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির কারণে ২১ জানুয়ারি থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করে সরকার, যা শেষ হওয়ার কথা ৬ ফেব্রুয়ারি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আরও ১৫ দিনের ছুটি ঘোষণায় অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থী তৌহিদা আক্তার বলেন, দুই বছরের শিক্ষার ক্ষতি কী করে পুষিয়ে নেব? তার এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আমরা পাইনি। এখন আবার যদি এভাবে মাসের পর মাস বন্ধ থাকে, আমাদের শিক্ষাজীবন কোন দিকে যাবে? আমাদের ভবিষ্যৎ কী হবে? আমরা টিকা নিয়েছি। এখন ক্লাসে যেতে চাই।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাবেয়া সুলতানা বলেন, অনলাইনের ক্লাস ঠিকমতো বুঝতে পারি না। সরাসরি ক্লাসের বিকল্প অনলাইন হতে পারে না। আমরা সরাসরি ক্লাসে ফিরে যেতে চাই।

রাজউক উত্তরা স্কুল অ্যান্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী তাসনুবা রাওদা বলেন, অনেক দিন পর যখন ক্লাস শুরু হচ্ছিল, ভালো লেগেছে। এখন আবার ক্লাস বন্ধ থাকায় পড়ালেখায় মন বসছে না। আমরা দ্রুত ক্লাসে যেতে চাই।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ফের ছুটি প্রসঙ্গে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী আমাদের সময়কে বলেন, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার প্রতি ব্যাপক চাহিদা রয়েছে কিন্তু আমরা সেই চাহিদা মেটাতে পারছি না। তারা স্কুল বন্ধ থাকায় ছুটছে কোচিংয়ে। সরকার স্কুল বন্ধ রাখতে পারলেও কোচিং বন্ধ রাখতে পারেনি।

তিনি বলেন, সবই খোলা! জীবন-জীবিকা যেমন গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন চলমান রাখা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, বাকি সব ক্ষেত্রেই আমরা এত ঝুঁকি নিই, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার ক্ষেত্রে ঝুঁকিটা অনেক বড় হয়ে গেল! বিষয়টি হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখায় কি সংক্রমণ বাড়ছে? তা তো নয়। বাড়ছে তো সব কিছু স্বাভাবিক ও সচল রাখার কারণে। শপিংমল, বাণিজ্যমেলা, বাজার, নির্বাচনী জনসভা সবই চলছে। বিশ্বের অনেক দেশ ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখছে। তারা বুঝতে পারছে শিক্ষার্থীরা কত বড় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। আমরা কেন বুঝতে পারছি না!

রাশেদা কে চৌধূরী আরও বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যদি বন্ধই রাখতে হয়, আমাদের বিকল্প ব্যবস্থা অনেক শক্তিশালী করতে হবে। আমাদের তো দীর্ঘ ১৮ মাসের অভিজ্ঞতা আছে। অনলাইন ক্লাস, টেলিভিশন ক্লাস কিন্তু সবার কাছে পৌঁছেনি। এটা নীতিনির্ধারকরাও জানেন।

তিনি বলেন, দীর্ঘ সময় ঘরবন্দি থাকায় শিক্ষার্থীদের মনোসামাজিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তারা হতাশায় ডুবছে। এমনকি আত্মহত্যার প্রবণতাও বাড়ছে। চাকরির বয়স বাড়ছে। তারা চাকরিতে প্রবেশের বয়স ছাড় দেওয়ার দাবি তুলছেন। এতে সরকার ছাড় দিচ্ছে না। এখন স্থানীয় সরকার নির্বাচন করে আগামীর রাজনৈতিক নেতৃত্ব নির্বাচিত করব। তা হলে আগামীর দেশ পরিচালনায় যারা নেতৃত্ব দেবে তাদের তৈরি করছি না কেন? টিকা প্রদান কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। সর্বত্র স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় বাধ্য করতে হবে।

এদিকে, জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক তহবিল ইউনিসেফ শুক্রবার এক বিবৃতিতে স্কুল খোলা রাখার আহ্বান জানিয়েছে। এতে বলা হয়, স্কুলগুলো পুরোপুরি বা আংশিক বন্ধ থাকায় বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৬১ কোটি ৬০ লাখ শিশু ক্ষতিগ্রস্ত। কোভিড ১৯-এর ওমিক্রন ধরনটি সারা বিশ্বে যখন ছড়িয়ে পড়ছে, এটি যাতে শিশুদের পড়াশোনাকে ব্যাহত করতে না পারে, সে জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে।

পড়াশোনার ক্ষেত্রে বিপর্যয় এড়াতে এবং শিশুদের তাদের শেখার পথে ফিরিয়ে আনতে ইউনিসেফ সুপারিশ হচ্ছে- স্কুল খোলা রাখুন। ডিজিটাল সংযুক্তির পেছনে বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে পারলেই কোনো শিশু পেছনে পড়ে থাকবে না। প্রতিটি শিশুকে স্কুলে ফিরিয়ে আনতে আমাদের জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে প্রতিটি কমিউনিটির প্রান্তিক শিশুদের ওপর বিশেষ লক্ষ্য রেখে কিছু বিষয়ে বিস্তৃত সহায়তা প্রদান করা। যেমন- শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের ঘাটতি পূরণে অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়া, মানসিক স্বাস্থ্য ও পুষ্টিসহায়তা, সুরক্ষা ও অন্য সুবিধাদি নিশ্চিত করতে হবে।

টিকাধারী শিক্ষার্থীদের ক্লাসে আনার ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের দেশ অত্যন্ত ঘন বসতির দেশ। এখানে সংক্রমণ ছড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এজন্য সরকার লেখাপড়ারা চেয়ে জীবন বাঁচার কৌশল হিসেবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখছে। কিন্তু এ বন্ধে সার্বিক শিক্ষা বন্ধ থাকবে- এটা হয় না। আমাদের শিক্ষার অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে গেল দুই বছরে। এখনো যদি শিক্ষার্থীদের ক্লাসের বাইরের শিক্ষা পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত করতে না পারি আমাদের শিক্ষার ঘাটতি কীভাবে পূরণ করব। সব স্তরের শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে ক্লাসে না আনা গেলেও যারা টিকা নিয়েছে তাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্লাসে আনার ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। অনলাইন ক্লাস হলে সেই ক্লাসের ফলোআপ যদি সরাসরি ক্লাসে নেওয়া হয় তা হলে কার্যকর হবে। অনলাইন অফলাইন দুটোতে আমাদের সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের শিক্ষকরা এত দিনে কতটা উপযুক্ত হয়েছেন? তারা সরাসরি ক্লাসের পাঠদানের থেকে অনলাইন ক্লাসে দক্ষতা অর্জন করেছেন কিনা? আমাদের শিক্ষার্থীদের কাছে কতটা পৌঁছতে পেরেছি এ পদ্ধতিতে। দুই বছরেও যদি এগুলোর সমস্যা নিরসন করতে না পারি আমাদের ছেলেমেয়েরা অনেক পিছিয়ে যাবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের বিপুল সংখ্যক শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের টিকাদান এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। দেশে ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থী এক কোটি ১৬ লাখ ২৩ হাজার ৩২২ জন। এর মধ্যে টিকার প্রথম ডোজ পেয়েছে ৪৪ লাখ, দ্বিতীয় ডোজ ৪ লাখ ১৯ হাজার ৫৫৪ জন। অর্থাৎ টিকা পেয়েছে ৪৮ লাখ ১৯ হাজার ৫৫৪ শিক্ষার্থী। পাবলিক, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে মোট শিক্ষার্থী ৪৪ লাখ ৩৪ হাজার ৪৫১ জন। এর মধ্যে টিকার প্রথম ডোজ পেয়েছেন ২৩ লাখ ২৮ হাজার ৪৬৮ জন, দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়েছে ১৭ লাখ ১৩ হাজার ৩০২ জনকে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ২৯ লাখ জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের। বাকিদের মধ্যে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯৫ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী টিকা পেয়েছেন। সারাদেশের শিক্ষকদের প্রায় সবার টিকা নেওয়া সম্পন্ন হয়েছে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877